ব্যাংক জামানত-এর প্রকারভেদ ও গুরুত্ব

এইচএসসি (বিএমটি) ভোকেশনাল - ফিন্যান্সিয়াল কাস্টমার সার্ভিসেস-২ - ব্যাংক জামানত | NCTB BOOK

ব্যাংক জামানতের প্রকারভেদ (Types of Bank Mortgage )

রফিক সাহেব তার গাজীপুরের ১০ কাঠা জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণের টাকায় কারখানা নির্মাণ করছেন। ব্যাংক থেকে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে তার মেশিনপত্র ক্রয় ও স্থাপন ব্যয় নির্বাহ করছেন। এই ঋণে ব্যাংকের কাছে তিনি ব্যক্তিগত জামানত হিসেবে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু জনাব শওকতকে জামিনদার করেছেন। 46 1 2 উৎপাদিত পণ্য ব্যাংকে বন্ধক রেখে চলতি মূলধন সরবরাহ নিশ্চিত করছেন। এই ঘটনায় দেখা যায় যে, ব্যাংক বিভিন্ন রকমের জামানত সংরক্ষণ করে। ব্যাংক ঋণ প্রদানকালে ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা চায়। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা নিশ্চয়তাস্বরূপ যেসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকের নিকট গচ্ছিত রাখে তাকে জামানত বলে। জামানত ঋণের সমমানের বা তার বেশি মূল্যমানের হয়। জামানত বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এই ধরন নির্ভর করে ঋণের প্রকৃতি, ঋণগ্রহীতার সামর্থ্য ও ব্যাংকের শর্তাবলির ওপর। নিচে জামানতের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো—

১.ব্যক্তিগত জামানত (Personal security) : 

যখন ব্যাংক ঋণগ্রহীতা ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির নিশ্চয়তাপত্রের বিপরীতে ঋণ প্রদান করে তখন তাকে ব্যক্তিগত জামানত বলে। যে ব্যক্তি এ নিশ্চয়তাপত্র প্রদান করে তাকে জামিনদার বলে। ব্যক্তিগত জামানতের ক্ষেত্রে জামিনদারের অর্থনৈতিক অবস্থা, চরিত্র, সুনাম ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। জামিন প্রদানকারী তার নিশ্চয়তাপত্রে উল্লেখ করে যে, ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ ফেরত দিতে না পারলে জামিন প্রদানকারী ঋণের অর্থ সুদসহ পরিশোধ করবে। ব্যক্তিগত জামানতে তিনটি পক্ষ থাকে। যথা— ক. ঋণদাতা (ব্যাংক) খ. ঋণগ্রহীতা গ. জামিনদার।

২.অব্যক্তিগত জামানত (Impersonal security) : ব্যাংক ঋণদানকালে যখন ঋণের জামানত হিসেবে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ দেয় তখন তাকে অব্যক্তিগত জামানত বলে। এ ধরনের জামানত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাংক জামানতি সম্পত্তির মালিকানা, হস্তান্তরযোগ্যতা, দায়মুক্ততা, মূল্য, গুণগত মান, তারল্য ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে। এ ধরনের জামানত হতে পারে ভূমি, দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, পণ্যদ্রব্য, বিক্রয়যোগ্য শেয়ার, সিকিউরিটি ইত্যাদি। অব্যক্তিগত জামানত আবার চার ধরনের। যেমন-

• পূর্বস্বত্ব (Lien) : যে পদ্ধতিতে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের পূর্ব পর্যন্ত ঋণগ্রহীতার সম্পদ আটক রাখার অধিকার রাখে তাকে পূর্বস্বত্ব বলে। পূর্বস্বত্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঋণগ্রহীতা জামানতি সম্পত্তির প্রকৃত মালিক হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত সম্পদ বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবে না। অপরদিকে, LOAN be applying for surance is selected, your III. TERMS OF LOAN Term (years) 30 No. Months 360 LIENS If you own payment is les ed to co ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না ও ঋণ অনাদায়ী হয়েছে— এটি প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকও উক্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে না। পূর্বস্বত্ব দুই ধরনের হয়— সাধারণ পূর্বস্বত্ব এবং বিশেষ পূর্বস্বত্ব।

• পণ্যদ্রব্য বন্ধক (Commodity mortgage ) : যে পদ্ধতিতে ঋণগ্রহীতা ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্যাংকের কাছে পণ্যদ্রব্যের দখলিস্বত্ব ছেড়ে দেয়, তখন তাকে পণ্যদ্রব্য বন্ধক বলে । এক্ষেত্রে পণ্যের মালিকানা দলিল বা গুদামের চাবি ঋণ পরিশোধের পূর্ব পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে জমা থাকে। ঋণগ্রহীতা চাইলে পণ্য বিক্রি করতে পারে না।

• স্থায়ী সম্পদ বন্ধক (Fixed asset mortgage ) : যখন ঋণগ্রহীতা জামানতি স্থাবর সম্পদের আংশিক বা সম্পূর্ণ স্বত্ব বা অধিকার ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করে তখন তাকে স্থায়ী সম্পদ বন্ধক বলে। ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাংক জামানত স্থাবর সম্পদের স্বত্বাধিকার লাভ করে এবং সম্পদ বিক্রি করে ঋণের অর্থ আদায় করতে পারে। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের নিকট সম্পত্তির দলিলপত্র হস্তান্তর করে মাত্র। কিন্তু সম্পত্তির ভোগদখল ঋণগ্রহীতার কাছেই থাকে। ঋণগ্রহীতা ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য ব্যাংক আদালতে আবেদন করবে। আদালত ন্যায়সঙ্গত মনে করলেই সম্পত্তি বিক্রির অনুমতি প্রদান করে ।

দখলহীন বন্ধক বা হাইপোথিকেশন ( Unoccupied mortgage ) : যখন কোনো অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে ব্যাংকের কাছে রাখা হয়, কিন্তু পণ্যের দখল ও মালিকানা ঋণগ্রহীতার নিকটই থাকে তখন তাকে দখলহীন বন্ধক বলে। ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ব্যাংক ঐ সম্পত্তি ক্রোক করে নিজের দখলে আনতে পারে। সাধারণত ব্যবসায়িক পণ্যের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দখলহীন বন্ধক ব্যবহৃত হয়। একে হাইপোথিকেশনও বলা হয়।

৩.অতিরিক্ত জামানত (Additional collateral) : 

যখন ব্যাংক ঋণের অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মূল জামানতের পাশাপাশি আরও কিছু জামানত গ্রহণ করে তখন তাকে অতিরিক্ত জামানত বলে। এ জামানত ব্যক্তিগত ও অব্যক্তিগত উভয়ই হতে পারে। যেমন— ব্যাংক ১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে প্রথমে ৫ বিঘা জমি জামানত নেয়, পরে ২.৫ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ১ তলা বাড়িটিও বন্ধক রাখে। এখানে ১ তলা বাড়িটি অতিরিক্ত জামানত। ব্যাংক ঋণের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জামানত নেয়। এ জামানত ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার বিভিন্নমুখী চাহিদার কারণে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে।

ব্যাংক জামানতের গুরুত্ব ( Importance of Bank Mortgage )

   মনোয়ার সাহেব দীর্ঘ ২০ বছর পদ্মা ব্যাংকে কর্মরত আছেন। জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দিয়ে আজ তিনি নিজ যোগ্যতায় শাখা ব্যবস্থাপক হয়েছেন। সাতক্ষীরা তার নিজ এলাকা। সেখানে পাঁচ বছর আগে তিনি বদলি হয়ে এসেছেন। মনোয়ার সাহেবের বাবার পুরানো বন্ধু বাবর সাহেব যখন তার চিংড়িঘের উন্নয়ন ও চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্পের জন্য ব্যাংক ঋণের আবেদন করেন, তখন মনোয়ার সাহেব গভীর বিশ্বাস ও বাবর সাহেবের সুনাম বিবেচনা করে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করেন জামানত ছাড়াই। বর্তমানে সুদ-আসলে এই অর্থ দাঁড়িয়েছে ৮৫ লক্ষ টাকায়, যা বাবর সাহেব পরিশোধ করতে পারছেন না। জামানত ছাড়া এ ধরনের ঋণ মঞ্জুর করায় ব্যাংক মনোয়ার সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে রেখেছে। ওপরের ঘটনা থেকে জামানতের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। নিচে জামানতের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো- 

▪️ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা (Assurance of loan repayment) : ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো ঋণদানের মাধ্যমে তহবিলের কাম্য ব্যবহার (Optimum use of fund) নিশ্চিত করা। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই প্রদত্ত ঋণের অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা ছাড়া ঋণ দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। কারণ প্রদত্ত ঋণের অর্থ জনগণের আমানত থেকে সৃষ্ট। এই অর্থ যেকোনো সময় আমানতকারী উত্তোলন করে নিতে পারে। তাই ব্যাংক ঋণের অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা হিসেবে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে উপযুক্ত জামানত বন্ধক রাখে। ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তার জন্য ব্যাংকের কাছে এই জামানত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

▪️ব্যক্তিক ও অব্যক্তিক জামানত (Personal & Impersonal guarantee) : নতুন ব্যবসায় ও ব্যবসায়ীকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক অনিশ্চয়তার দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে ঋণের অর্থ ফেরত পাবে কি না। এই অনিশ্চয়তা দূর করে উপযুক্ত জামানত বন্ধক রেখে ব্যাংক আমানতি অর্থ দিয়ে ঋণের ব্যবসায় করে। তাই প্রদত্ত ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করা ব্যাংকের জন্য অপরিহার্য। ঋণ প্রদানের সময় গ্রহীতার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ও অব্যক্তিগত জামানত গ্রহণ করে প্রদত্ত ঋণের ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করে। আর্থিক সামর্থ্যবান ও ব্যাংকের পরিচিত স্বনামধন্য ব্যক্তির জামানতেও ব্যাংক ঋণ দেয়। ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরতদানে অপারগতা প্রকাশ করলে জামিনদার উক্ত অর্থ ফেরত দেয়। যদি জামিনদার অর্থ দিতে আপত্তি করে তবে আইনের আশ্রয় নিয়ে ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের অর্থ আদায় করতে পারে।

▪️ জামানতি সম্পদের মূল্য (The value of the security assets) : জামানতি সম্পদের মূল্য সাধারণত প্রদত্ত ঋণের চাইতে বেশি থাকে বলে ঋণগ্রহীতা সচেতন থাকে যত দ্রুত সম্ভব ঋণের অর্থ ফেরত দিতে। কারণ ব্যাংক জামানত সম্পদ বিক্রয় করে দিলে তার মূল্যবান সম্পদ সে তার নিজ মালিকানায় রাখতে পারবে না। ব্যাংক যখন জামানত রাখে তখন জামানতের মূল্য, বিক্রয়যোগ্যতা, তারল্য ক্ষমতা ইত্যাদি বিচার-বিশ্লেষণ করেই ঋণ মঞ্জুর করে থাকে।

▪️প্রতারণা হতে রক্ষা (Protection from fraud): জামানত রাখার আরেকটি বড় সুবিধা হলো অসাধু ঋণগ্রহীতার প্রতারণা থেকে আত্মরক্ষা করা। এভাবে আমানতকারীদের আমানতের নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা যায়।

▪️জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি (Increasing the quality of life) : জামানত রাখলে ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের ফলে যে লোকসান হয় তা থেকে রক্ষা পায় এবং মুনাফা অর্জন অব্যাহত রাখতে পারে। জামানত ব্যবস্থা থাকায় ব্যাংক ঋণদানে উৎসাহিত হয়। কারণ জামানত থাকার ফলে ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ সহজেই ফেরত পাওয়া যায়। এছাড়া যথাসময়ে ঋণের অর্থ ফেরত পেয়ে ব্যাংক সেই ঋণ আবার অন্যকে দেয়, এভাবেই ঋণের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্র প্রসারিত হয় এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ সহজ হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। ব্যবসায়ীরা ব্যাপক হারে ঋণ নেয়, বিনিয়োগ করে এবং কর্মসংস্থান ঘটে। ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ে ও জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পায়।

▪️রপ্তানি বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন (Increasing exports and earning foreign currency) : ব্যাংক ঋণের অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা হিসেবে উপযুক্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে বন্ধক রাখে। এসব সম্পদ জামানত রাখার ফলে ব্যাংক যথাসময়ে প্রদত্ত ঋণের অর্থ আদায় করতে পারে এবং পুনরায় কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। এতে করে দেশের মোট উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ে। 

▪️সচেতনতা সৃষ্টি (Creating awareness) : জামানত ঋণগ্রহীতাকে ঋণের উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকতে সাহায্য করে। ঋণের শর্তাদি ও পরিশোধের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে ঋণগ্রহীতাকে সচেতন রাখে । এতে করে ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার সম্পর্ক ভালো থাকে।

   অতএব, জামানত ব্যবস্থা ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এতে করে ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ঠিকমতো ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব ঋণদান কর্মসূচি সচল রাখতে পারে। তাই ঋণের ক্ষেত্রে জামানতের গুরুত্ব অপরিসীম।

Content added By
Promotion